ভূমিকম্প অনেক সময় নিজে অনিরাপদ সংকেত ছাড়াও হঠাৎ ঘটে যেতে পারে। বাংলাদেশে ভূমিকম্প-ঝুঁকি থাকায় প্রত্যেক নাগরিকের জন্য মৌলিক প্রস্তুতি থাকা জরুরি। এই পোস্টে আমরা সহজ ও প্রায়োগিক দিশা দেবো — কী করে সতর্ক থাকা যায়, ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে, এবং পরে কী ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে জীবন ও সম্পদ রক্ষা করা যায়।
১) ভূমিকম্প কি এবং কেন ঘটে?
ভূপৃষ্ঠের নিচে স্তরগুলোর আয়তনে বা গতিতে পরিবর্তন হলে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে ভূমিকম্প সাধারণত ভারতীয় প্লেট ও বিএঙ্গল দখলকারী টেকটনিক কার্যকলাপের প্রভাবেই ঘটে থাকে। কিছু ভূমিকম্প ক্ষুদ্র হয়, আবার কিছু অধিক মাত্রার হলে ক্ষতি ডেকে নিয়ে আসতে পারে।
২) ভূমিকম্পের আগে কীভাবে প্রস্তুতি নিবেন
- ইমার্জেন্সি কিট তৈরি করুন: পানি (কমপক্ষে ৩ লিটার/প্রতি মানুষ/দিনের হিসাব), শুকনো খাবার, ব্যাটারি-টর্চ, পাওয়ার-ব্যাংক, প্রাথমিক ওষুধ, ফার্স্ট-এড কিট, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রের কপি (ব্যাংক, আইডি) একটি জলের টকিতে রাখুন।
- পরিবার পরিকল্পনা ও যোগাযোগ নির্দেশিকা: জরুরি সময় পরিবারের প্রত্যেকের সাথে যোগাযোগের একটি প্ল্যান তৈরি করুন — কোথায় মিলবেন, কোন নম্বরে কল করবেন।
- বাড়ির নিরাপত্তা 점검: ভারী আসবাবপত্র দেয়ালে ভালভাবে ফিক্স করুন; বই-আলমারি, টিভি বা রেফ্রিজারেটর তিনটে-চারের উপরে থাকলে নিচে নড়াচড়া থেকে সুরক্ষিত স্থানে রাখুন।
- নিরাপদ স্থান চিহ্নিত করুন: ঘরের ভিতরে 'Drop, Cover, Hold On' করার স্থান এবং বাড়ির বাইরে মিলনস্থল আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন — মুক্ত মাঠ, ফুটপাথের পাশে খোলা জায়গা ইত্যাদি।
- প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিন: স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস বা রেড ক্রিসেন্টের দেওয়া সেভিং টিউটোরিয়াল দেখুন ও পরিচিত হোন।
৩) ভূমিকম্প শুরু হলে করণীয় (Drop, Cover, Hold On)
ঘরে থাকলে:
- Drop: দ্রুত নিচু জমিতে নাহয় মাটিতে বসে পড়ুন— স্ট্যান্ড করে থাকার চেষ্টা করবেন না।
- Cover: মাথা ও ঘাড়কে রক্ষা করে এমন কোনো শক্ত বাট (table/desk)-এর নিচে ঢুকুন; যদি না থাকে দেয়ালের কাছে কুঁকড়ে মাথা ঢেকে নিন।
- Hold On: যেটি ঢেকে নিচ্ছেন সেটাকে ধরে রাখুন যতক্ষণ না কাঁপুনি থামছে।
বহির্বিশ্বে থাকলে মুক্ত জায়গায় নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়ান— ভবনের পাশে দাঁড়াবেন না; ডাঙায়, তার-কলামে বা বড় গাছের কাছে থেকে দূরে থাকুন।
৪) ভূমিকম্পের সময় যা করবেন না
- দৌড়ে বাইরে যাওয়ার সময় লিফট ব্যবহার করবেন না।
- বাসা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ আসবাব অট্টালিকা থেকে লাফিয়ে পড়বেন না।
- উঁচু বিল্ডিং থেকে নিচে ঝুঁকি নিয়ে নেমে আসার চেষ্টা করবেন না— প্রথমে কাঁপুনি থামলে ধাপে ধাপে নিরাপদভাবে চলুন।
৫) ভূমিকম্প শেষ হওয়ার পর জরুরি করণীয়
- প্রথমত: নিজের ও পরিবারের সুরক্ষা যাচাই করুন— কেউ আহত হলে দ্রুত ফার্স্ট-এড দিন এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে নিন।
- গ্যাস লাইন, বৈদ্যুতিক সুইচ ও পানি সরবরাহ বন্ধ করুন যদি লিক বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।
- ভাঙচুর ও বৈদ্যুতিক তারপাইপের পাশে থেকে দূরে থাকুন।
- রেডিও/টিভি/দূরবীক্ষণ থেকে স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশ অনুসরণ করুন।
- ফোন লাইন ব্যাস্ত থাকতে পারে— জরুরি যোগাযোগে এসএমএস বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করুন এবং অনলাইনে মিথ্যা খবর ফলানোর আগে যাচাই করুন।
- ভবনের ক্ষত— যদি ভবনটি গুরুতর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, নিরাপদে বাইরে থেকে অপেক্ষা করুন এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ভবনে ফিরবেন না।
৬) স্কুল-সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের জন্য বেসিক গাইডলাইন
- নিয়মিত ভূমিকম্প-ড্রিল আয়োজন করুন এবং শিক্ষার্থীরা কোথায় মিলবে তা প্রাকটিস করিয়ে নিন।
- স্কুল-ভিত্তিক এমার্জেন্সি কিট ও ত্রাণ সামগ্রী প্রস্তুত রাখুন।
- ভবন নিরাপত্তা অডিট— দরজা/জানালা ও বেরোনোর পথ স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করুন।
৭) প্রশাসনিক ও কমিউনিটি স্তরের সতর্কতা
- স্থানীয় প্রশাসন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিস ও সিভিল সার্ভিসের নির্দেশ মেনে চলুন।
- জেলার জরুরি হটলাইন নম্বর, স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র সম্পর্কে আগে থেকে অবগত থাকুন।
- কমিউনিটি-ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করলে তা সাহায্য করে দ্রুত উদ্ধার কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে।
৮) মানসিক সমর্থন ও পরে পুনর্বাসন
ভূমিকম্পের পর মানসিক চাপ ও আতঙ্ক দেখা দেয়— পরিবারে ঝগড়া বা অনিদ্রা বৃদ্ধি পেতে পারে।
- পরিবারিক সমর্থন গড়ে তুলুন— মনে করিয়ে দিন যে সহায়তা আসবে এবং শরীর-মন সুস্থ রাখতে ধীরভাবে কাজ করুন।
- স্থানীয় হেল্পলাইন বা সাইকোলজিক্যাল কেয়ার সার্ভিস খুঁজে নিন যদি কারও উদ্বেগ বা PTSD-র লক্ষণ থাকে।
৯) দ্রুত পরীক্ষার চেকলিস্ট (প্রতি পরিবারে রাখুন)
- জরুরি ব্যাগ (৩ দিন) — পানি, খাবার, ওষুধ, বাতি/টর্চ, চার্জার
- পরিবার সংকেত ও মিলনস্থান
- বাচ্চা/বৃদ্ধদের জন্য অতিরিক্ত কেয়ার আইটেম
- স্থানীয় জরুরি ফোন নম্বর ও আশ্রয়কেন্দ্রের ঠিকানা
১০) উপসংহার — সচেতনতা বাঁচায়
ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা কঠিন, কিন্তু প্রস্তুতি, জ্ঞান ও দ্রুত সিদ্ধান্ত জীবন রক্ষা করতে পারে। আপনার বাড়ি ও পরিবারকে নিরাপদ রাখুন— জরুরি কিট প্রস্তুত রাখুন, যোগাযোগের পরিকল্পনা তৈরি করুন এবং নিয়মিত ড্রিল অনুশীলন করুন। স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশ সবার আগে মেনে চলুন এবং সহায়তা প্রয়োজন হলে সহযোগিতা করুন।
এই গাইডটি আপনার দ্রুত সহায়তার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। পরিবার-বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন যাতে সবাই সতর্ক ও প্রস্তুত থাকতে পারে।
